Tuesday, April 20, 2021

শ্রী কৃষ্ণ মুক্তআত্মা নন, তিনি পরমেশ্বর:

শ্রী কৃষ্ণ মুক্তআত্মা নন, তিনি পরমেশ্বর :


বাসুদেবকে মুক্ত আত্মা প্রমান করার জন্য কিছু ধর্ম ব্যাবসায়ীক মানসিকতা ধারীরা উঠে পড়ে লেগেছেন। আসুন তাদের উল্লেখকৃত রেফারেন্সগুলি দেখে নেওয়া যাক: 


মুক্ত আত্মার পক্ষের যুক্তি:


উপনিষদে আমরা দেখতে পাই গুরু শিষ্যকে   অহংভাবে "আমি,  আমার " বোধে উপদেশ দেওয়ার প্রমাণ পেয়ে থাকি। উদাহরণ স্বরূপ ছান্দোগ্যপনিষদে সনদ মুনি উপদেশ দিচ্ছেন -


"তিনিই নিম্নে, তিনি উর্ধে, তিনি পশ্চাতে, তিনি সম্মুখে,  তিনি পশ্চাতে,  তিনি দক্ষিনে,  তিনি উত্তরে অর্থাৎ তিনি সর্বত্র। এর পরই আবার তিনি অহংভাবে উপদেশ দিচ্ছেন - আমিই অধোভাগে, আমি উর্ধে,  আমি পশ্চাতে,  আমি সম্মুখে,  আমি পশ্চাতে,  আমিই দক্ষিনে।

..................... ছান্দোগ্যপনিষদ ৭।২৫।১


[এখানে বিশেষ ভাবে এই কথাটা বলে রাখতে হবে যে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন মুক্ত পুরুষ, আর মুক্ত পুরুষরা তাহা পারেন। শ্রীকৃষ্ণ যখনই উচিৎ মনে করেন তখনই মানুষী শরীর ধারণ করিবেন ইহা তার ইচ্ছা ]


ছান্দগ্যোপনিষদ ও বেদান্তসূত্রেও বলা আছে যে মুক্ত জীবাত্মারা তা পারেন। প্রমাণ দেখুন-

"ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্পামননাৎ"

(বেদান্তসূত্র ৪।৪।১১)

অর্থাৎ মুক্ত আত্মার দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি থাকে, ইহা জৈমিনি মুনিরর মত। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে যে, তারা নানা রূপ দেহধারণ করার ক্ষমতা আছে।


"...তিনি(মুক্ত জীবাত্মা) এক প্রকার থাকেন, তিন প্রকার হন, পঞ্চ প্রকার, সপ্ত প্রকার এবং নব

প্রকার হন...।"

.................................ছান্দোগ্যোপনিষদ্৭ ।২৬।২)


 

এছাড়াও তিনি যে যা ইচ্ছে তাই পেয়ে থাকেন তথা করতে পারেন।  তার প্রমাণ আরো দেখুন-

 

"তিনি যদি পিতৃলোক কামনা করেন, তবে তাহার সঙ্কল্পমাত্রই পিতৃগণ তাঁহা সহিত মিলিত হন...। মাতৃলোক কামনা করলে মাতৃগনের সহিত মিলিত হন... ভাতৃলোক কামনা করলে তাদের সহিতও মিলিত হতে পারেন... । ভগিনীলোক কামনা করলে, বন্ধুলোক কামনা কললে তাদের সহিতও মিলিত হন। এক কথায় যাহা চান তাহাই প্রাপ্ত হন।"

..............................ছান্দোগ্য_উপনিষদ ৮।২।১-১০)


অথাত আত্মাদেশ এবাত্মৈবাধস্তাদাত্মোপরিষ্টাদাত্মা পশ্চাদাত্মা পুরস্তাদাত্মা দক্ষিণত আত্মোত্তরত অাত্মৈবেদং সর্বমিতি স বা এষ এবং পশ্যন্নেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন অাত্মানন্দঃ স স্বরাড়্ ভবতি তস্য সর্বেষু লোকেষু কামচারো ভবত্যথ যেহন্যথাহতো  বিদুরন্যরাজানস্তে ক্ষয্যলোকা ভবন্তি তেষাং সর্বেষু লোকেষ্বকামচারো ভবতি।।

 

অনুবাদ: অনন্তর আত্মা-অবলম্বনে উপদেশ (প্রদত্ত হইতেছে) আত্মাই নিম্নে, আত্মা উর্ধ্বে, আত্মা পশ্চাতে, আত্মা সম্মুখেআত্মা দক্ষিণে, আত্মা উত্তরে, আত্মাই এই সমস্ত এইরুপ দর্শন  করিয়া, এইরুপ মনন করিয়া, এইরুপ সবিশেষ জানিয়া, আত্মরতি, আত্মক্রীড়, আত্মমিথুন, আত্মানন্দ হইয়া পুর্বোক্ত সেই বিদ্বান্ সরাট্ হন সমস্ত লোকে তিনি অপ্রতিহত গতি প্রাপ্ত হন পক্ষান্তরে যাহারা   এতদ্ভিন্ন অন্যরুপে জানে, তাহারা অপর রাজার অধীন ক্ষয়শীল লোকের অধিবাসী হয়, সমস্ত লোকে তাহাদের অপ্রতিহত গতি হয়না।



অবিভাগেন দৃষ্টত্বাৎ।।৪/৪/৪।।

অর্থ্যাৎ মু্ক্তাত্মা পরব্রহ্মকে অবিভক্ত রূপে অনুভব করেন।পরমাত্মার একান্ত ঐক্য দর্শন করেন।মুক্তাত্মা ব্রহ্মসমন্ধী গুণ সম্পন্ন হন ইহা ছান্দোগ্য উপনিষদের ৮/৭/১ কথা।আর এই জন্যই মুক্তাত্মারা বদ্ধ জীবের মত নয়। এ সমন্ধে পরবর্তী সূত্রে বলা হয়েছে।


সংকল্পাদেব তু তচ্ছ্রতেঃ।।৪/৪/৮।।

সকল জীবের সংকল্পসিদ্ধির জন্য প্রয়ত্নের প্রয়োজন। মুক্তাত্মা সেরূপ নহে। মুক্তাত্মার সংকল্প মাত্রেই সিদ্ধি হয়। অর্থ্যাৎ পরমেশ্বর যেমন সংকল্প করা মাত্রেই সিদ্ধি, মুক্তাত্মাও তদ্রুপ। এই রূপ ইচ্ছামাত্র সংকল্পসিদ্ধি শ্রেষ্ঠ যোগীগণেরও হয়।পরবর্তী সূত্রে আরো বলা হয়েছে।


অতত্রব চাননাধিপতিঃ।।৪/৪/৯।।

সত্যসংকল্পত্ব প্রাপ্তি হয় বলিয়া মুক্তাত্মা কাহারো অধীন নহে। তাই ছান্দোগ্য শ্রুতি বলিয়াছে "স স্বরাড ভবতি"[৭/২৫/২]।সমুদয় লোকে মুক্তাত্মার স্বাতন্ত্র হয়। ভক্তের স্বাতন্ত্র্যের সহিত ভগবানের নিয়ন্তৃত্বের বিরোধ নাই।


জগদ্ব্যাপারবর্জং প্রকরণাদসন্নিহিতত্বাচ্চ।।৪/৪/১৭।।

মুক্তাত্মা ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তির কথা উল্লেখ আছে কিন্তু জগদ্ব্যাপারবর্জং অর্থ্যাৎ "সৃষ্টি- স্থিতি-নাশ রূপে কার্য একমাত্র পরব্রহ্মেরই। মুক্তাত্মারা ব্রহ্ম প্রাপ্তি হইলেও সে জগদ্ব্যাপার লাভ করতে পারে না।জগৎ সৃষ্ট্যাদি কার্য ব্রহ্মের অসাধারণ লক্ষণ।সুতারাং বলা যায় পরমেশ্বর ছাড়া সৃষ্টি স্থিতি নাশ কেউই করতে পারে না।


বিকারাবর্তি চ তথাহি স্থিতিমাহ।।৪/৪/১৯।।

বিকারাবর্তি বিকারের অবর্তি---জন্ম, স্থিতি,বৃদ্ধি,অবক্ষয়, পরিণাম, নাশ এই ছয় প্রকার বিকার যাহাতে বর্তে না তিনিই পরমেশ্বর।


অনাবৃত্তিঃ শব্দাদনাবৃত্তিঃ শব্দাৎ।। ৪/৪/২২।।




ভক্তিপরায়ণ যোগীগণ, আমাকে লাভ করে আর এই দুঃখ্পূর্ণ নশ্বর সংসারে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন না, তারা সর্বোচ্চ সিদ্ধি লাভ করেন।[ভগবদগীতা-৮/১৫]


 জগদ্ব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ অসন্নিহিতত্বাচ্চ।।

বেদান্ত সূত্র ৪/৪/১৭

মুক্তপুরুষের ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তির কথা উল্লেখ আছে। উহা কিন্তু জগদ্ব্যাপারবর্জং অর্থাৎ সৃষ্টি-স্থিতি-নাশ রুপে  কার্য একমাত্র পরব্রহ্মস্বরুপেরই। মুক্ত পুরুষের ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তি হলেও সে জগদ্ব্যাপার লাভ করেন না।

য ইহ আত্মানমনুবিদ্য (ছান্দোগ্য ৮/১/৬) এবং স যদি পিতৃলোককামো ভবতি (ছান্দোগ্য ৮/২/১-১০) ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যের দ্বারা মুক্ত পুরুষের পরম সাম্য ও সত্য সঙ্কল্পতা প্রভৃতি গুণ আবির্ভূত হয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে যে মুক্ত পুরুষ সৃষ্ট্যাদি কতৃত্বও লাভ করিবে কি না? যতো বা ইমানি ভূতানি(তৈত্তিরীয় ৩/১/১) শ্রুতি বাক্যের বিচার করলেও ব্রহ্ম পক্ষেই নিতে হবে কারন এখানে জীব সম্বন্ধীয় কোনো কথা পাওয়া যায়না। জন্মাদ্যস্য যত: (ব্রহ্ম সুত্র ১/১/২) বাক্যে ব্রহ্ম লক্ষন কথিত।

শ্রীনিম্বার্কভাষ্যে:

জগৎসৃষ্ট্যাদিব্যাপারেতরৎ মুক্তৈশ্বর্য্যমে্। কুত: ?   ‘‘যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে” ইত্যাদৌ পরব্রহ্মপ্রকরণান্মুক্তস্য তত্রাসন্নিহিতত্বাচ্চ।”

শ্রী মাধ্বভাষ্যে:

সর্ব্বান্ কামানাপ্যামৃত: সমভবদিত্যুচ্যতে তত্র

সৃষ্ট্যাদিভ্যোহন্যান্ ব্যাপারানাপ্নোতি।”

শ্রীরামানুজ ভাষ্যে:

মুক্তপুরুষ জগৎসৃষ্ট্যাদি-সামর্থ্য লাভ করেন না। মুক্তপুরুষের ঐশ্বর্য্য যথাযথরুপে ব্রহ্মানুভব করা, এই সিদ্ধান্তের কারণ-প্রকরণ, যেখানে শ্রুতিতে জগৎসৃষ্টির বিষয় আছে, সেখানে পরব্রহ্মের প্রসঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায়। তারপর অসন্নিহিতত্বও দ্বিতীয় কারণ; যেহেতু জগৎসৃষ্ট্যাদি-ব্যাপারের যেখানে উল্লেখ আছে, সেখানে মুক্তপুরুষের উল্লেখ দেখা যায়না।


অনাবৃত্তি: শব্দাদনাব্রত্তি শব্দাৎ

বেদান্ত সুত্র ৪/৪/২২

আব্রহ্মভুবনাল্লোকা: পুনরাবর্তিনোহর্জুন।

মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুণর্জন্ম ন বিদ্যতে।।

আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। এই সুত্রে তাহাই বলিয়াছেন। মুক্ত আত্মার আর পুনরাবৃত্তি হয় না।

………….গীতা ৮/১৬

কর্মই পুনর্জন্মের কারণ। মুক্ত পুরুষের সঞ্চিত প্রারব্ধ ও ত্রিয়মান সর্বপ্রকার কর্মের বীজ নি:শেষে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। সুতরাং পুনর্জন্মের কারণ বিদ্যমান না থাকায় পুনর্জন্ম অসম্ভব।


No comments:

Post a Comment