Tuesday, March 8, 2022

রুদ্র সম্প্রদায়:

রুদ্র সম্প্রদায়:



                                                               ছবি: বিষ্ণুস্বামী


হিন্দুধর্মে রুদ্র সম্প্রদায় চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম বল্লভাচার্য্য (ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগ) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক এবং জগৎগুরু নিম্বার্কাচার্য্যের মতো তিনিও শ্রীকৃষ্ণকেই সচ্চিদানন্দবিগ্রহ পূর্ণব্রহ্ম বলে স্বীকার করেন তাঁর মতে ব্রহ্ম  জীব মূলতঃ অভেদ হলেও জীব ব্রহ্মের অংশ জীবসমূহ জগৎ সূক্ষ্মরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্হিত এই ঈশ্বর সমস্ত সদগুণের আধার এবং যাবতীয় বৈচিত্র্য এবং বিরুদ্ধতার আশ্রয় একই সময়ে এক এবং বহু বল্লভের মতে সৃষ্টি ভ্রম নয়, অসৎ মায়াও নয় সৎ মায়াশক্তি অবলম্বন করেই ব্রহ্ম নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেছেন অগ্নির সঙ্গে স্ফুলিঙ্গের অথবা মণির সঙ্গে জ্যোতির যে সম্বন্ধ তাই ব্রহ্মের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক তিনি মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ স্বীকার করতে চাননি; তাই তাঁর মতবাদকে শুদ্ধ-অদ্বৈত্ব বলে অভিহিত করা হয় বল্লভাচার্য্য শুদ্ধা ভক্তির পথিক, এই ভক্তি তাঁর মতে কর্ম বা জ্ঞান থেকে আসে না ঈশ্বরকৃপাই এর আবির্ভাব ঘটায় বৈষ্ণবদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এই সম্প্রদায়েও বিষ্ণু বা তার অবতার কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর মনে করা হয় রুদ্র সম্প্রদায়ের প্রবর্তক সন্ত বিষ্ণুস্বামী যদিও এই সম্প্রদায়ের উৎস রুদ্র নামধারী শিব যিনি ভগবান বিষ্ণু (বা কৃষ্ণ) দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞান মানবজাতিকে দিয়েছিলেন বৈষ্ণব মত অনুসারে শিব হলেন প্রথম এবং প্রধান বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর অনুগামী এই সম্প্রদায়ের মতে, বিষ্ণুস্বামী ছিলেন বৈষ্ণবদের পঞ্চদশ গুরু যিনি বিষ্ণুমাহাত্ম্য শিষ্যসমাজে প্রচার করেন এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তনের তারিখটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে জেমস হেস্টিংসের মতে বিষ্ণুস্বামী পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন কিন্তু কার্ল অলসনের মতে, তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রুদ্র সম্প্রদায়ের অনুগামীগণ অবশ্য বিষ্ণুস্বামীর জন্ম ,৫০০ বছর আগে হয়েছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিক বিষ্ণুস্বামীর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না তার সকল রচনা কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে পশ্চিম ভারতের গুজরাট অঞ্চলে এই ধর্ম প্রথম প্রচারিত হয়েছিল পরবর্তীকালে বল্লভ আচার্য (১৪৭৯- ১৫৩১ খ্রি.) এই সম্প্রদায়ের মুখ্য প্রবক্তা হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় রুদ্র সম্প্রদায়ের আবার দুটি উপবিভাগ রয়েছে: বিষ্ণুস্বামীর অনুগামী বিষ্ণুস্বামীগণ এবং বল্লভ আচার্য প্রবর্তিত বল্লভগণ বা পুষ্টিমার্গ সম্প্রদায় উইলিয়াম ডেডওয়েলারের মতে, পুষ্টিমার্গ সম্প্রদায় বাদে রুদ্র সম্প্রদায়ের বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই এই সম্প্রদায়ের দর্শন হল কৃষ্ণপ্রধান শুদ্ধাদ্বৈত মতবাদ এই সম্প্রদায়ের অনুগামীগণ কৃষ্ণকে একাকী অথবা রাধার সঙ্গে পূজা করেন কৃষ্ণের অপর এক রূপ বালগোপাল- এই সম্প্রদায়ের পূজ্য হিন্দুধর্মে সন্ন্যাসজীবন আদর্শ হলেও রুদ্র সম্প্রদায়ে পুরোহিতদের সংসারধর্ম পালনে উৎসাহিত করা হয় এই সম্প্রদায় বিবাহ করে পরিবার প্রতিপালনের কথা বলে


জগৎগুরু আচার্য্যদের মতবাদ:

জগৎগুরু আচার্য্যদের মতবাদ: 

বেদান্ত প্রাচীন উপনিষদগুলিকে ভিত্তি করে বেদান্ত দর্শন গড়ে উঠেছে। বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র এর একটি মূল গ্রন্থ। বেদান্তকে ভিত্তি করে মুখ্যতঃ যে মতবাদগুলি প্রচলিত সেগুলি হল, (১) নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদ, (২) শ্রী সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ, (৩) শৈব সম্প্রদায়ের অদ্বৈতবাদ (৪) মাধ্ব সম্প্রদায়ের দ্বৈতবাদ, (৫) বল্লভ সম্প্রদায় বা পুষ্টিমার্গ সম্প্রদায়ের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ এবং (৬) গৌড়ীয়দের অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ। এছাড়াও ভাস্করের ‘ঔপাধিক ভেদাভেদবাদ’, শ্রীকণ্ঠের ‘বিশিষ্টশিবাদ্বৈতবাদ রয়েছে।

 (১) নিম্বার্কের ভেদাভেদবাদ বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদঃ ভেদাভেদবাদের মতানুসারে নিম্বার্কাচার্য ভেদ এবং অভেদ এই উভয় কল্পনা করে ব্রহ্ম, জগৎ এবং জীব এই তিনটিকে ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত করে বলেছেন যে, চেতন এবং অচেতন জগৎ ব্রহ্ম হতে ভিন্নও বটে অভিন্নও বটে। রামানুজের মত নিম্বার্কও (খৃীঃ1100-1162) ঈশ্বরকে সচ্চিদানন্দস্বরূপ, জগত-কারণ, অপ্রাকৃতবহুগুণাধার প্রভৃতি রূপে উপলব্ধি করেন। পার্থক্য এই যে, শ্রীকৃষ্ণকেই ঈশ্বর ও শ্রীমতী রাধাকে তাঁর শক্তি বলে তিনি অনুভব করেন। এবিষয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিমতের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য। রামানুজের মত তিনিও জীবাত্মাকে স্বরূপতঃ চেতন, জ্ঞানাশ্রয়, ঈশ্বর-নিয়ন্ত্রিত, ঈশ্বরাশ্রিত, পরিমাণে অনু এবং সংখ্যায় অনন্ত প্রভৃতি মনে করেন। পার্থক্য এই যে, চিৎ এবং অচিৎময় বিশ্বকে তিনি ঈশ্বরের দেহ বলে মনে করেন না, শক্তির পরিণাম বলেই চিন্তা করেন। রামানুজাচার্য্য ভেদকে স্বীকার করলেও তাঁর মতে অভেদের প্রাধান্য, জীবজগত বা যাবতীয় প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ নিয়ে ঈশ্বর একরি সমগ্র একক সত্তা। নিম্বার্কের মতে কেবল অভেদ হলে ঈশ্বরও দুঃখভাগী হয়ে পড়েন, তাঁর পূর্ণ শুদ্ধ সত্তা থাকে না। আবার চিৎ ও অচিৎ যেহেতু তাঁর শক্তি- পরিণাম বা অংশ, সেইহেতু অভেদও তাঁর মতে সত্য। ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের ও জগতের ভেদ এবং অভেদ বিষয়ে কারণ-কার্যের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছেন নিম্বার্ক| ব্রহ্ম কারণ এবং জীব ও জগত তাঁর কার্য্য। ব্রহ্ম অংশী, জীব-জগত অংশ, ব্রহ্ম জ্ঞেয়, জীব জ্ঞাতা, ব্রহ্ম উপাস্য, জীব উপাসক, অন্তর্যামী ব্রহ্ম নিয়ন্তা, জীব নিয়ন্ত্রিত। আবার ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ, জগত জ্ঞানহীন। নিম্বার্ক এই ভেদ ও অভেদকে স্বাভাবিক মনে করেছেন বলে তাঁর অভিমতকে বাস্তব ভেদাভেদবাদ বলে অভিহিত করা হয়। 


 (২) রামানুজাচার্য্যের বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদ রামানুজ (1017-1137 খৃষ্টাব্দ) বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। এই মতে ব্রহ্ম ও জীব স্বতন্ত্র। ব্রহ্ম এক, অদ্বিতীয় এবং সর্বব্যাপী; জীব এক নয়, জীব বহু, প্রতি শরীরে বিভিন্ন। রামানুজাচার্য্যের মতে জগৎ মিথ্যা নয়, জগতের প্রকৃত সত্তা আছে। জগৎ ব্রহ্মের মায়াশক্তি প্রসূত। তাঁর মতে পরমাত্মা জীবজগৎ বিশিষ্ট–চিৎ অর্থাৎ জীব এবং অচিৎ অর্থাৎ জড়– এই দুইই তাঁর বিভূতি। রামানুজম্ ‘ক্ষর’র অর্থ করেছেন বদ্ধ আত্মা অর্থাৎ অচিৎ-সংসর্গ যুক্ত জীব যে বারবার মৃত্যুর অধীন হয়; আর অক্ষরের অর্থ মুক্ত আত্মা সংসর্গ মুক্ত জীব যার ক্ষরণ অর্থাৎ ক্ষয় নেই যিনি জন্ম-মৃত্যুর অধীন হন না। পরমাত্মা হচ্ছেন উত্তম পুরুষ অর্থাৎ বদ্ধ আত্মা এবং মুক্ত আত্মা উভয়ই। উত্তম পুরুষ ক্ষর এবং অক্ষর পুরুষ এই দুই হতেই ভিন্ন। রামানুজাচার্য্যের মতে জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হলেও জগৎ ও জীব বিশিষ্ট। তাঁর মতে ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকলেও স্বগত ভেদ অবশ্য স্বীকার্য্য।রামানুজাচার্য্যের শিক্ষা হল বর্ণাশ্রম ধর্ম অবশ্য পালনীয়। ফলাকাঙ্খা বিসর্জন করে ঈশ্বরকে প্রসন্ন করবার জন্য বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করলে ভাব সংশুদ্ধি হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয়। 


 (৩)   শঙ্করাচার্য্যের অদ্বৈতবাদঃ শঙ্করাচার্য্যের আবির্ভাব কাল নিশ্চিতরূপে নির্ধারিত করা যায় না; খুব সম্ভবতঃ তিনি খৃষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষপাদ ও নবম শতকের প্রথমপাদে (খৃঃ788-880) ছিলেন। শঙ্করাচার্য্য বিশ্বসত্তাকে অবিভাজ্য এবং এক কল্পনা করেছেন বলেই তাঁর মতবাদকে অদ্বৈতবাদ বলা হয়। তিনি শিক্ষা দিলেন, ব্রহ্ম সত্য জগন্মিথ্যা "জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ" অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, এই বিশ্ব মিথ্যা এবং জীবাত্মা ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন। এই যে জগৎ প্রত্যক্ষ হচ্ছে যা পরিবর্তনশীল এবং যা নাম ও রূপ এই দুয়ের সমন্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা ভ্রম মাত্র যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই ভ্রম ব্রহ্মের মায়াশক্তির প্রভাব। অর্থাৎ আমাদের এই ভ্রম বা ভুলের কারণ হল মায়া। এই মায়া তত্ত্বও অদ্বৈতবাদের একটি অবিভাজ্য অংশ। এইজন্য এই মতবাদকে মায়াবাদ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে মায়ার উল্লেখ পাওয়া যায়, "ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈস্নতে যুক্তা হ্যস্য হরয়ঃ শতা দশেতি।" অর্থাৎ ইন্দ্র মায়ার সাহায্যে বিরাট আকার ধারণ করেছেন; তাঁর রথের অশ্বের সংখ্যা দশ শত। শঙ্করাচার্য্যের মতে ব্রহ্ম সকল অবস্হাতেই একমেবাদ্বিতীয়ম্ অর্থাৎ ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। কোন অবস্হাতেই তিনি বহু নন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে জগৎ তা ব্রহ্ম হতে পৃথক নয়; তাকে আমরা ভুল করে বহু আকারে দেখি। শঙ্করাচার্য্যের মতে এই যে দেখার ভুল তার কারণই হল মায়া। মায়া শক্তিটির এমনই ক্ষমতা আছে যা আসল জিনিষটির প্রকৃত রূপকে আবৃত করে রাখে এবং তার বিকৃত রূপটিকে প্রকট করে। সুতরাং দৃশ্যমান বিশ্ব ব্রহ্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত, তাই ব্রহ্ম। কিন্তু তাঁকে দেখার ভুলে আমরা বহুরূপে দেখি। শঙ্করাচার্য্য ব্যাখ্যা করেছেন যে ক্ষর হল জীবজগৎ, এর সর্বদা ক্ষরণ বা ক্ষয় হচ্ছে। আর অক্ষর হল কূটস্হ জগতের সব কিছুর উৎপত্তির বীজ। শঙ্করাচার্য্যের মতে এটিই মায়া। এই কারণ-রূপিণী মায়া আর কার্য্যরূপীজীবজগতের উপরে আছেন উত্তম পুরুষ যিনি পরমাত্মা। শঙ্করাচার্য্যের মতে অজ্ঞানতাই হল দ্বৈতভাবের উৎপাদক। এই দ্বৈতভাব হতেই সকল কর্ম হয়। দ্বৈতভাব নাশ হলেই নিষ্ক্রিয় আত্মা প্রতিষ্ঠিত হয় আর তাহলেই কর্মসন্ন্যাস হয়। তখনই মানুষের আত্মজ্ঞান লাভ হয়।


 (৪) মাধবাচার্য্যের দ্বৈতবাদঃ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মাধবাচার্য্য (খৃীঃ1199-1276) তাঁর মতবাদ দ্বৈতবাদ প্রচার করেন। মধ্বাচার্য কিন্তু ব্রহ্মকে জগতের নিমিত্ত-কারণ মাত্র বলেই গ্রহণ করেন, উপাদান-কারণ হিসেবে নয়। তাঁদের মতে জীব বাস্তবিকই অণু, কর্তা এবং ঈশ্বরেরই অংশ বিশেষ। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেবযানের পথে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মে লীন হন এবং আর মর্ত্যলোকে প্রত্যাবর্তন করেন না। তাঁরা শঙ্করের মতো জ্ঞানকে উচ্চ বা নিম্ন বলে পার্থক্য করেন না। তাঁদের মতে জ্ঞান নয়, ভক্তিই মুক্তিলাভের প্রধান উপায়। এভাবে তাঁদের সবার কাছে ব্রহ্ম, জগৎ এবং জীব সব কিছুই সত্য। তাঁর মতে- ব্রহ্ম, জীব ও জগৎ - এই তিনটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। মাধবাচার্য্যের মতে বিশ্বের স্রষ্টা ও সৃষ্ট পৃথক| মাধবাচার্য্য মায়াবাদ খন্ডন করে পরব্রহ্মের সহিত জীবসমূহের নিত্য ভেদ প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি পাঁচ প্রকারের ভেদ দেখালেন– ঈশ্বরে ও জীবাত্মায় ভেদ, জীবাত্মা ও জীবাত্মায় ভেদ, আত্মা ও জড়ে ভেদ, ঈশ্বরে ও জড়ে ভেদ এবং জড়ে ও জড়ে ভেদ এমনকি তিনি মুক্ত আত্মার মধ্যেও আনন্দ উপভোগের তারতম্য নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে সমস্ত জ্ঞানই হল ভেদমূলক। কোন বস্তুকে জানার অর্থ হলো অন্য বস্তু থেকে পৃথক করে জানা| রামানুজ যাকে গুণ ও ধর্ম বলেছেন মাধবাচার্য্য তাকেই পৃথকত্ব বলেছেন। তাঁর মতে এই পৃথকত্ব বা বিভেদই বাস্তব সত্য। তিনি বিবেচনা করেছেন যে জীব ও জড় বা প্রকৃতি ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল বা ঈশ্বরের ইচ্ছায় ক্রিয়াশীল এবং ঈশ্বর হলেন সর্বময় কর্তা| তাঁর মতে সবিশেষ ব্রহ্ম স্বতন্ত্র, আর জীব অস্বতন্ত্র। মাধবের মতে এক জীবাত্মা অন্য থেকে পৃথক, এমনকি মুক্তির পরেও আনন্দ তারতম্য লাভ করে পৃথক সত্তা নিয়েই বর্তমান থাকে অর্থাৎ সাযুজ্য, সালোক্য, সামীপ্য এবং সারূপ্য এই চার প্রকার মুক্তির মধ্যে সাযুজ্য মুক্তিতেও ঈশ্বর জীবাত্মার পার্থক্য বিদ্যমান থাকে। মাধব মতে উপাস্য হলেন বৈকুন্ঠনাথ নারায়ণ বা লক্ষ্মীনারায়ণ, ব্রজলীলার নায়ক কৃষ্ণ নন। এই মতে তিনি রামানুজাচার্য্যের সঙ্গে একমত; কিন্তু সাধনপথ সম্পর্কে পার্থক্য আছে। 


 (৫) বল্লভাচার্য্যের শুদ্ধ-অদ্বৈতবাদঃ বল্লভাচার্য্য (ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগ) শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক এবং নিম্বার্কের মত তিনিও শ্রীকৃষ্ণকেই সচ্চিদানন্দবিগ্রহ ‘পূর্ণব্রহ্ম’ বলে স্বীকার করেন। তাঁর মতে ব্রহ্ম ও জীব মূলতঃ অভেদ হলেও জীব ব্রহ্মের অংশ। জীবসমূহ ও জগৎ সূক্ষ্মরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্হিত। এই ঈশ্বর সমস্ত সদগুণের আধার এবং যাবতীয় বৈচিত্র্য এবং বিরুদ্ধতার আশ্রয়। একই সময়ে এক এবং বহু। বল্লভের মতে সৃষ্টি ভ্রম নয়, অসৎ মায়াও নয়। সৎ মায়াশক্তি অবলম্বন করেই ব্রহ্ম নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেছেন। অগ্নির সঙ্গে স্ফুলিঙ্গের অথবা মণির সঙ্গে জ্যোতির যে সম্বন্ধ তাই ব্রহ্মের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক। তিনি মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ স্বীকার করতে চাননি; তাই তাঁর মতবাদকে শুদ্ধ-অদ্বৈত্ব বলে অভিহিত করা হয়। বল্লভাচার্য্য শুদ্ধা ভক্তির পথিক, এই ভক্তি তাঁর মতে কর্ম বা জ্ঞান থেকে আসে না। ঈশ্বরকৃপাই এর আবির্ভাব ঘটায়। 


 (৬) শ্রী বলদেব বিদ্যাভূষণের অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ: বৈষ্ণবগণ বিষ্ণু অথবা তাঁর অবতার রূপ কৃষ্ণ বা রামের উপাসক| বর্তমানে যে পাঁচটি ভাগ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলির প্রবর্তক হলেন রামানুজাচার্য্য, মাধবাচার্য্য, নিম্বার্ক, বল্লভ এবং শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। বৈষ্ণব তত্ত্ব প্রধানতঃ দ্বৈতবাদী এবং ভক্তি নির্ভরশীল। উপরে এই দর্শনগুলির তত্ত্ব সংক্ষেপে বিবৃত করা হয়েছে। যেমন, রামানুজাচার্য্য তাঁর বিশিস্ট অদ্বৈতবাদ মতবাদে বেদান্ত দর্শন এবং পঞ্চরাত্র দর্শনের সমন্বয় করে ভক্তি ও বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল বৈষ্ণব মতবাদ প্রচার করেন। তাঁর মতে ঈশ্বর ও আত্মা (জীব) এক নয়, ভিন্ন। একমাত্র ঈশ্বরের কৃপাতেই জীব আত্মা পূর্ণতা অর্থাৎ মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করতে পারে। মাধবাচার্য্য তাঁর দ্বৈতবাদে বলেন যে ব্রহ্ম, জীব ও জগত, তিনটিই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। তাঁর মতে বিশ্বের স্রষ্টা ও সৃষ্টি পৃথক। মাধবাচার্য্য শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদ খন্ডন করে বললেন পরব্রহ্মের থেকে জীবের প্রভেদ আছে। তিনি ঈশ্বরকে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করলেন। বিশ্বস্রষ্টার সঙ্গে ভক্তির সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষা দিলেন যে ভক্তিই চরম নিষ্ঠা। আচার্য নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদে তান্ত্রিক দৃষ্টিতে ভেদাভেদবাদ এবং সাধনমার্গে রাধাকৃষ্ণ ভক্তিবাদ শিক্ষা দেওয়া হল। বল্লভাচার্যের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ মতে ব্রহ্ম ও জীব মূলতঃ অভেদ হলেও জীব ব্রহ্মের অংশ; জীবসমূহ ও জগত সূক্ষ্মরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্থিত। মায়া ঈশ্বরের শক্তি মাত্র, জগত প্রপঞ্চ মিথ্যা নয় এবং ভগবত কৃপাই তাঁকে লাভ করার একমাত্র পন্থা। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য (শ্রীচৈতন্য নামেও সমধিক পরিচিত) যে বৈষ্ণব দর্শন প্রচার করেন তা ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন’ বা ‘অচিন্ত্য ভেদাভেদ দর্শন’ নামে পরিচিত। এই অদ্বৈত তত্ত্ব অচিন্তনীয়, যার সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। পরম বৈষ্ণব শ্রীধর গোস্বামী এবং জীব গোস্বামী ‘অচিন্ত্য’ শব্দটির ব্যাখ্যা করে উদাহরণ দিয়েছেন আগুন ও তার দাহ করার শক্তির কথা বলে অর্থাৎ আগুনের দাহ করার শক্তি অবর্ণনীয়। ‘ভেদাভেদ’ শব্দটি ব্যাখ্যা করতে তাঁরা ব্যবহার করেছেন সমুদ্র ও তার ঢেউএর উদাহরণ; ঢেউকে যেমন সমুদ্র থেকে আলাদা করে বর্ণনা করা যায় না। ঢেউ সমুদ্রেরই অংশ অর্থাৎ ঢেউ সমুদ্র থেকে আলাদা নয় তেমনি মুক্ত জীবাত্মা পরম ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়। অচিন্ত্য ভেদাভেদ দর্শন মতে এই সৃষ্টি চিরন্তন নয় কিন্তু মিথ্যাও নয়। এই সৃষ্টি ঈশ্বরের অপ্রকাশিত রূপ যা শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়েছে। অচিন্ত্য ভেদাভেদ দর্শন মতে ঈশ্বরের দুটি রূপ– একটি হল স্বঅংশ যা থেকে অবতার জন্ম নেন; দ্বিতীয় রূপটি হল বিভিন্ন অংশ অর্থাৎ যা থেকে জীবের উৎপত্তি হয়| জীবাত্মার স্বরূপত চিরন্তন, অর্থাৎ জীবাত্মা তার স্বরূপ কখনই হারিয়ে ফেলে না। মায়া-শক্তি, যা দেহ ও ইন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন, তার ফলেই জীবাত্মা মানব দেহে অবস্থান করে। এই মায়া-শক্তি ঈশ্বরের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন কার্য্য সম্পাদন করতে পারে না। অচিন্ত্য ভেদাভেদ দর্শন জীবকে দুভাবে বর্ণনা করেছে– নিত্যমুক্ত, যাদের আত্মা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং নিত্য-সংসারী, যাদের আত্মা সংসারে বদ্ধ অর্থাৎ সংসারের সুখ-দুঃখ চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। এই নিত্য-সংসারী সত্যকারের মোক্ষলাভ করবেন তখনই যখন প্রেম-ভক্তির সাহায্যে নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি বুঝতে পারবেন। বৈষ্ণব দর্শনের মূল শিক্ষা হল যে যখনই জীব অন্ধকার রূপ মায়ার জাল থেকে বেরিয়ে আসার সযত্ন প্রচেষ্টা করে তখনই তাকে সাহায্য করতে ঈশ্বর সদা প্রস্তুত। ঈশ্বর এই ভক্তকে কৃপা করেন, আশীর্বাদ করেন। সেই আশীর্বাদে মায়া পরিণত হয় সম্যক জ্ঞানে। এই জ্ঞানরূপ অগ্নিতে জীবাত্মার সব ভুল-ভ্রান্তি ঘুচে যায়। জীব পরমাত্মার স্বরূপ জানতে পারে আর তখনই মোক্ষলাভ করে। বৈষ্ণব দর্শনের মত হল যে জীবাত্মা জন্ম-মৃত্যুর চক্রব্যুহে ঘোরে এবং সম্যক জ্ঞান লাভ করে যখন মোক্ষলাভ করে তখন পরম ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হলেও নিজ সত্ত্বাকে অক্ষুন্ন রেখে ভগবানের আশীর্বাদ পেয়ে আনন্দে থাকেন।