রুদ্র সম্প্রদায়:
হিন্দুধর্মে রুদ্র সম্প্রদায় চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম। বল্লভাচার্য্য (ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগ) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক এবং জগৎগুরু নিম্বার্কাচার্য্যের মতো তিনিও শ্রীকৃষ্ণকেই সচ্চিদানন্দবিগ্রহ পূর্ণব্রহ্ম বলে স্বীকার করেন। তাঁর মতে ব্রহ্ম ও জীব মূলতঃ অভেদ হলেও জীব ব্রহ্মের অংশ। জীবসমূহ ও জগৎ সূক্ষ্মরূপে ঈশ্বরের বিরাট শরীরে অবস্হিত। এই ঈশ্বর সমস্ত সদগুণের আধার এবং যাবতীয় বৈচিত্র্য এবং বিরুদ্ধতার আশ্রয়। একই সময়ে এক এবং বহু। বল্লভের মতে সৃষ্টি ভ্রম নয়, অসৎ মায়াও নয়। সৎ মায়াশক্তি অবলম্বন করেই ব্রহ্ম নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করেছেন। অগ্নির সঙ্গে স্ফুলিঙ্গের অথবা মণির সঙ্গে জ্যোতির যে সম্বন্ধ তাই ব্রহ্মের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক। তিনি মায়ার সঙ্গে ব্রহ্মের সম্বন্ধ স্বীকার করতে চাননি; তাই তাঁর মতবাদকে শুদ্ধ-অদ্বৈত্ব বলে অভিহিত করা হয়। বল্লভাচার্য্য শুদ্ধা ভক্তির পথিক, এই ভক্তি তাঁর মতে কর্ম বা জ্ঞান থেকে আসে না। ঈশ্বরকৃপাই এর আবির্ভাব ঘটায়। বৈষ্ণবদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এই সম্প্রদায়েও বিষ্ণু বা তার অবতার কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর মনে করা হয়। রুদ্র সম্প্রদায়ের প্রবর্তক সন্ত বিষ্ণুস্বামী। যদিও এই সম্প্রদায়ের উৎস রুদ্র নামধারী শিব। যিনি ভগবান বিষ্ণু (বা কৃষ্ণ) দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞান মানবজাতিকে দিয়েছিলেন। বৈষ্ণব মত অনুসারে শিব হলেন প্রথম এবং প্রধান বৈষ্ণব বা বিষ্ণুর অনুগামী। এই সম্প্রদায়ের মতে, বিষ্ণুস্বামী ছিলেন বৈষ্ণবদের পঞ্চদশ গুরু যিনি বিষ্ণুমাহাত্ম্য শিষ্যসমাজে প্রচার করেন। এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তনের তারিখটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জেমস হেস্টিংসের মতে বিষ্ণুস্বামী পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু কার্ল অলসনের মতে, তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রুদ্র সম্প্রদায়ের অনুগামীগণ অবশ্য বিষ্ণুস্বামীর জন্ম ৪,৫০০ বছর আগে হয়েছিল বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক বিষ্ণুস্বামীর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। তার সকল রচনা কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম ভারতের গুজরাট অঞ্চলে এই ধর্ম প্রথম প্রচারিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বল্লভ আচার্য (১৪৭৯- ১৫৩১ খ্রি.) এই সম্প্রদায়ের মুখ্য প্রবক্তা হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। রুদ্র সম্প্রদায়ের আবার দুটি উপবিভাগ রয়েছে: বিষ্ণুস্বামীর অনুগামী বিষ্ণুস্বামীগণ এবং বল্লভ আচার্য প্রবর্তিত বল্লভগণ বা পুষ্টিমার্গ সম্প্রদায়। উইলিয়াম ডেডওয়েলারের মতে, পুষ্টিমার্গ সম্প্রদায় বাদে রুদ্র সম্প্রদায়ের বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই। এই সম্প্রদায়ের দর্শন হল কৃষ্ণপ্রধান শুদ্ধাদ্বৈত মতবাদ। এই সম্প্রদায়ের অনুগামীগণ কৃষ্ণকে একাকী অথবা রাধার সঙ্গে পূজা করেন। কৃষ্ণের অপর এক রূপ বালগোপাল-ও এই সম্প্রদায়ের পূজ্য। হিন্দুধর্মে সন্ন্যাসজীবন আদর্শ হলেও রুদ্র সম্প্রদায়ে পুরোহিতদের সংসারধর্ম পালনে উৎসাহিত করা হয়। এই সম্প্রদায় বিবাহ করে পরিবার প্রতিপালনের কথা বলে।
No comments:
Post a Comment