Tuesday, December 14, 2021

গীতা পূর্বেই ছিলো নাকি মহাভারতের অংশ হিসাবে এসেছে?

গীতা পূর্বেই ছিলো নাকি মহাভারতের অংশ হিসাবে এসেছে?




অনেকেই বলেন গীতা মহাভারতের অংশ কারন মহাভারত থেকে গীতাকে আলাদা করা হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি সাপোর্ট করলে নিচে উল্লেখিত গীতার শ্লোকটিকে বিকৃত বলিতে হবে। কিন্তু গীতা বিকৃত কিংবা প্রক্ষিপ্ত হতেই পারেনা কারন গীতাকে পরম্পরা গত জগৎগুরু আচার্য্যরা সর্ব্বোচ্চ মুল্যবান হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। 


শ্রীভগবানুবাচ,

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।

বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেহব্রবীৎ।।

এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।

কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ।।




অনুবাদ: শ্রীভগবান্বলিলেনএই অব্যয় যোগ আমি সূর্য্যকে বলিয়াছিলাম। সূর্য্য (স্বপুত্র) মনুকে এবং মন্য (স্বপুত্র) ইক্ষ্বাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন। এইরূপে পুরুষপরম্পরা প্রাপ্ত এই যোগ রাজর্ষিগণ বিদিত ছিলেন। হে পরন্তপ, ইহলোকে সেই যোগ দীর্ঘকালবশে নষ্ট হইয়াছে।

............. গীতা ৪/(১-২)


তাহলে গীতার সময়কাল কতো?


গীতার সময়কাল বের করতে আমাদের এই বিবস্বান থেকে মনু ও ইক্ষ্বাকু এই সময়কাল বের করিতে হইবে। আসুন দেখে নেই 


ত্রীণ্যপত্যানি ভো বিপ্রা: সংজ্ঞায়াংতপতাং বর:।

আদিত্যো জনয়ামাস কন্যাং দ্বৌ চ প্রজাপতী

মনুর্বৈবস্বত: পূর্ব্বং শ্রাদ্ধদেব: প্রজাপতি:।

যমশ্চ যমুনা চৈব যমজৌ সস্বভূবতু:।

 


অনুবাদ: সজ্ঞার গর্ভে বিবস্বানের অপত্য উৎপন্ন হয়, তন্মধ্যে একটি কন্যা এবং দুইটি পুত্র। তাঁহার দুই পুত্রই প্রজাপতি ছিলেন। তাঁহাদের একের নাম বৈবস্বত মনু এবং শ্রাদ্ধদেব। কন্যার নাম যমুনা। যমুনা ও যম যমজ হইয়াছিলেন।

…………… ৮নং শ্লোক, ৬অধ্যায়, ব্রহ্মপুরান।

 






লোমহর্ষন উবাচ,

মনোর্বৈবস্বতস্যাসন্ পুত্রা বৈ নব তৎসমা:।

ইক্ষ্বাকুশ্চৈব নাভাগো ধৃষ্ট: শর্যাতিরেব চ।।

নরিষ্যন্তশ্চ ষষ্ঠো বৈ প্রাংশূ রিষ্টশ্চ সপ্তম:।

করুষশ্চ পৃষধ্রশ্চ নবৈতে মুনিসত্তমা:।



অনুবাদ: লোম হর্ষন কহিলেন, হে মুনবরগণ! বৈবস্বত মনুর আত্মসম নয়টি পুত্র উৎপন্ন হয়। তাহাদের নাম ইক্ষ্বাকু, নাভাগ, ধৃষ্ট, শর্যাতি, সরিষ্যন্ত, প্রাংশু, রিষ্ট, করুষ, পৃষধ্র।

…………… ১নং শ্লোক, ৭অধ্যায়, ব্রহ্মপুরান।




এখান থেকে বোঝা গেলো এই বিবস্বান অর্থাৎ সুর্য্য দেব। অনেকেই এখন বলিতে পারেন যে পুরানের বক্তব্য আমি বা আমরা মানিনা। তাহলে আসুন দেখে নেই আর কোথাও এই সম্পর্কে কিছু রয়েছে কিনা?

আসুন বাল্মীকি রামায়ন কি বলে দেখে নেওয়া যাক,



পুরা কৃতযুগে রাম মনুর্দণ্ডধরঃ প্রভুঃ

তস্য পুত্রো মহানাসীদিক্ষ্বাকুঃ কুলনন্দনঃ।।

 

অনুবাদঃ শ্রীরাম! পূর্বের সত্যযুগের কথা, দণ্ডধারী রাজা মনু এই ভূতল শাসন করতেন তাঁর এক শ্রেষ্ঠ পুত্র ছিল, নাম হল ইক্ষ্বাকু রাজকুমার ইক্ষ্বাকু তাঁর কুলকে আনন্দে ভরে রাখতেন 

........... ০৫নং শ্লোক, ৭৯অধ্যায়উত্তর কাণ্ড, বাল্মিকী রামায়ন


এখান থেকেও বোঝা গেলো মনু পুত্রই ইক্ষ্বাকু।


কৃষ্ণই যে সূর্য্যদেবকে গীতার অব্যয় যোগ বলেছিলেন তার আরেকটি প্রমান:


কিঞ্চান্যদ্ বক্তুমিচ্ছামি রাক্ষসেন্দ্র মহাবল

আরধয় জগন্নাথমিক্ষ্বাকুকুলদৈবতম্।।

 

অনুবাদঃ মহাবলী রাক্ষসরাজ! এছাড়া আমি তোমাকে আরও একটি কথা বলতে চাই আমাদের ইক্ষ্বাকুকুলের দেবতা হলেন ভগবান জগন্নাথ (শ্রীশেষশায়ী ভগবান বিষ্ণু)


........... ৩০নং শ্লোক, ১০৮অধ্যায়,  উত্তর কাণ্ড, বাল্মীকি রামায়ণ।


জগন্নাথ যে কে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

ব্রহ্ম বৈবর্ত: জয় জগন্নাথ (brahma-vaivarta-special.blogspot.com)

যদি কনফিউশন থাকে তাহলে এই লিংকে গেলে সেই কনফিউশনও দুর হবে।



এখন বলবেন বাল্মীকি রামায়নের উত্তরকান্ড মানিনা। তাহলে বলিতে হয় আপনারা বাল্মীকি রামায়নই মানেন না। আসুন দেখে নেই বাল্মীকি রামায়নের বালকান্ড থেকে উত্তরকাণ্ডের রেফারেন্স।


চতুর্বিশৎ-সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান্ ঋষি:।

তথা সর্গশতান্পঞ্চ ষট্ কাণ্ডানি ততোত্তরম্।।

কৃত্বা তু তন্ময়প্রাজ্ঞ: সভবিষ্যং সহোত্তরম্।

চিন্তয়ামাস কো ন্বেতৎপ্রযুঞ্জীয়াদিতি প্রভু:।।



অনুবাদ: এই কাব্যে মহর্ষি চব্বিশ হাজার শ্লোক, পাঁচ শত সর্গ এবং ছয়টি কান্ড ও উত্তর কান্ড (উত্তর কান্ড সহ মোট সাত কান্ড) রচনা করেন। মহাপ্রাজ্ঞ মহর্ষি বাল্মীকি শ্রীরামচন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মধারাসহ, উত্তরকাণ্ড সমন্বিত সেই মহাকাব্য রচনা করার চিন্তা করতে লাগলেন- এমন কে আছে যে এই কাব্য জনসমাজে প্রচার করতে সমর্থ!


……………… (০২-০৩)নং শ্লোক, ৪র্থ স্বর্গ, বালকাণ্ড, বাল্মীকি রামায়ন।


এখন বলিতে পারেন কৃষ্ণের জন্ম দ্বাফরে সে কিভাবে সূর্যদেবকে গীতার অব্যয় যোগের জ্ঞান দ্বান করলেন?


কৃষ্ণের স্বরুপ বুঝিলে এমন কথা বলিতেন না। তারপরেও কনফিউশন দুর করিবার জন্য দেওয়া হলো


উৎপৎস্যতে হি লোকেহস্মিন্ যদূনা কীর্তিবর্ধনঃ।।২০।।

বাসুদেব ইতি খ্যাতো বিষ্ণু পুরুষবিগ্রহঃ

তে মোক্ষয়িতা শাপাদ্  রাজংস্তস্মাদ্ ভবিষ্যসি।।২১।।

কৃতা তেন কালেন নিস্কৃতিস্তে ভবিষ্যতি

ভারাবতরণার্থং হি নরনারায়ণাবুভৌ।।২২।।

উৎপৎস্যেতে মহাবীর্যৌ কলৌ যুগ উপস্থিতে

 

অনুবাদঃ যদুকুলের কীর্তি বৃদ্ধিকারী বাসুদেব নামে সুবিখ্যাত ভগবান শ্রীবিষ্ণু পুরুষ বিগ্রহে এই জগতে অবতীর্ণ হয়ে আসবেন, তখন তিনিই এই শাপ থেকে আপনাকে মুক্ত করবেন অতএব এখন থেকে আপনি গিরগিটি হয়েই অবস্থান করুন শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণকালে  আপনার উদ্ধার হবে কলিযুগ আসার কিছু আগে মহাপরাক্রমী নর নারায়ণ এই পৃথিবীর ভার লাঘব হেতু অবতীর্ণ হবেন

......... (২০.-২৩.)নং শ্লোক, ৫৩অধ্যায়, উত্তর কান্ড, বাল্মিকী রামায়ণ


এখানে দেখা যায় বিষ্ণু বাসুদেব বিগ্রতে দ্বাফরে অবতীর্ণ হন। গর্গ মুনি কৃ্ষ্ণকে চিনিতে পারিয়া বিষ্ণুকে কৃষ্ণই নামই প্রদান করেন।


ব্রহ্ম বৈবর্ত: October 2021 (brahma-vaivarta-special.blogspot.com)


নিন কনফিউশন দুর করিবার জন্য একটি লিংক দিলাম যেখানে বাল্মীকি রামায়ণে কৃষ্ণের উপস্থিতি দেখানো হলো। 

ব্রহ্ম বৈবর্ত: বেদের কৃষ্ণ (brahma-vaivarta-special.blogspot.com)


নিন কনফিউশন দুর করিবার জন্য একটি লিংক দিলাম যেখানে বেদে কৃষ্ণের উপস্থিতি দেখানো হলো।


আসুন দেখি শ্রী শ্রী চন্ডী কি বলে?


শূলং শুলাদ্ বিনিস্কৃষ্য দদৌ তস্যৈ পিনাকধৃক্।

চক্রঞ্চ দত্তবান্ কৃষ্ণ: সমুৎপাদ্য স্বচক্রত:।।



অনুবাদ: পিনাক নামক ধনুর্ধারী মহাদেব স্বীয় শূল হইতে শূলান্তর এবং বিষ্ণু স্বীয় সুদর্শন চক্র হইতে চক্রান্তর উৎপাদন করিয়া মহাদেবীকে দিলেন।

.............. শ্রী শ্রী চন্ডী ২/২০।



দ্বাফরের পূর্বে যে কৃষ্ণের উপস্থিতি ছিলো তার প্রমান দেওয়া হলো।  এখন দেখে নেয়া যাক গীতার উপস্থিতি কোথায় কোথায় ছিলো:




অস্মিন্নর্থে পুরা গীতা শ্রুয়ন্তে ধর্ম্মচিন্তকৈ:।

শ্লোকা ন্যায়মবেক্ষদ্ভিস্তত্ত্বার্থাস্তদর্শিভি:।।

 


অনুবাদ: পুরাকালে ধর্ম্মচিন্তাকারী, ন্যায়দর্শী ও তত্ত্বজ্ঞ লোকেরাও এই বিষয়েই কতকগুলি শ্লোক বলিয়া গিয়াছেন; তাহা আমরা শুনিয়া থাকি।

 

…………… ৫১নং শ্লোক, অধ্যায় ০৩, সোপ্তিক পর্ব, মহাভারত।



গীতার অব্যয় যোগ মহাভারতের অংশ নয়, গীতার মাহাত্ম্য বাদে শুধুমাত্র জ্ঞাণটুকু মহাভারতে যুক্ত করা হয়েছে। তবে গীতা আলাদা শাস্ত্র।


আসুন দেখে নেই এই শ্লোকের বিষয়ে কোথায় কি বলা হয়েছে?



................ শুক্ল যজুর্বেদ ১৮/০১



ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন
চাশুশ্রূষবে বাচ্যং মাং যোহভ্যসূয়তি ।।


অনুবাদ: যে তপস্যা করে না বা স্বধর্মানুষ্ঠান করে না, যে অভক্ত, যে শুনিবার ইচ্ছা রাখে না এবং যে আমাকে নিন্দা করে, এরূপ ব্যক্তিকে তুমি গীতাশাস্ত্র বলিবে না



ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি

ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ ।। 


অনুবাদ: যিনি এই পরম গুহ্যশাস্ত্র আমার ভক্তগণের নিকট ব্যাখ্যা করিবেন, তিনি আমাকে পরাভক্তি করায় (অর্থাৎ এই কার্যে আমি ভগবানেরই উপাসনা করিতেছি এইরূপ মনে করায়) আমাকেই প্রাপ্ত হইবেন, ইহাতে সন্দেহ নাই


................. গীতা ১৮/(৬৭-৬৮)


পদ্মপুরান ও বরাহপুরান অনুসারে গীতার মহাত্ম্যতে গীতাকে শাস্ত্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে






গীতা যে আলাদা শাস্ত্র এবং কেউ গীতাকে নতুন করে শাস্ত্রীয় মর্যাদা দেন নাই তার প্রমান গীতা থেকেই পাওয়া যায়।


আসুন দেখে নেওয়া যাক আর কোথাও গীতার কথা উল্লেখ রয়েছে কিনা?


তদ্ দ্বয়মপি সা গীতার্থপ্রত্যভিজ্ঞানাৎ



……… শাণ্ডিল্য ভক্তি সুত্র  ৮৩।



উপরোক্ত রেফারেন্স গুলিতে উল্লেখিত ই বৈবস্বত মনুই ঋগ্বেদের ৮ম মন্ডলের ২৭-৩১নং সুক্তের ভাব সম্প্রসারনকারি।




No comments:

Post a Comment